টেলিটকের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নে বিভিন্ন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ

লাস্টনিউজবিডি, ২৮ জানুয়ারি: টেলিটক ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বরে সীমিতভাবে সীমিত পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভ-জি পরীক্ষা চালায়। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিচালিত এই পরীক্ষামূলক অভিজ্ঞতার আলোকে রাজধানীতে ফাইভ-জি চালু করতে ২৩৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় । কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদিত না হওয়ায় ৫জি চালুর বিষয়টি বিলম্বিত হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। তবে নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি সরকারি অর্থায়নে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে নতুন করে ৩ হাজার টাওয়ার যোগ হবে। ফলে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও নেটওয়ার্ক কাভারেজ বৃদ্ধি পাওয়ায় টেলিটকের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং আগামীতে লোকসান কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।
টেলিটকের বর্তমান এমডি এ এক এম হাবিবু রহমান টেলিটকের নেটওয়ার্ক এবং সেবার মান বৃদ্ধি, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, ব্যয় সাশ্রয় এবং সর্বোপরি আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করার কাজ হাতে নিয়েছে । যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:- ক. রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদক্ষেপসমূহ:টেলিটকের ভয়েস ও ড্যাটা, এসএমএস সহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্যহার পুনর্মূল্যায়ন ও যৌক্তিকিকরণ- অধিক রাজস্বের সাইট বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আরও সাইট বৃদ্ধি- নেটওয়ার্ক কনজেশন দূর করে উন্নত গ্রাহক সেবা প্রদানের জন্য সাইটগুলোর ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি- উচ্চ রাজস্বের সাইটগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা/নজরদারি- লক্ষ্যমাত্রা এবং তা পূরণের হার অনুযায়ী চ্যানেল কমিশন নির্ধারণ- গ্রাহকদের ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন অফার নির্ধারণ- কর্পোরেট গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি- বন্ধ সিমের জন্য আকর্ষণীয় অফার প্রদানের মাধ্যমে সচল গ্রাহক বৃদ্ধি- বিভিন্ন প্যাকেজের অবিক্রিম সিম ফিরিয়ে এনে নতুন প্যাকেজের আওতায় পুনরায় বাজারজাত করা- জনসমাগম বেশী হয় এমন স্থানে (যেমনঃ হাসপাতাল, বড় শপিং মল) ইন্ডোর কাভারেজ বৃদ্ধি। খ. রাজস্ব আয়ের নতুন খাত তৈরির লক্ষ্যে পদক্ষেপসমূহ:- অন্য অপারেটরের নিকট টেলিকম স্থাপনা ভাড়া প্রদান- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবভিত্তিক বিশেষ প্যাকেজ ডিজাইন- কম রাজস্বের সাইটসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য বিশেষ মার্কেটিং পলিসি গ্রহণ- সিম বিক্রির জন্য বিকল্প চ্যানেল চালু (যেমন অনলাইন, কুরিয়ার, পোস্ট অফিস, রাস্তায় অস্থায়ী বুথ, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ইত্যাদি)। গ. ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে পদক্ষেপসমূহ:- কম রাজস্বের সাইটগুলো বিশেষ করে শেয়ার সাইটগুলো বন্ধ/স্থানান্তর- রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন- যানবাহন ও জ্বালানি ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় পরিবহণ পুল তৈরি- বিভিন্ন বিটিএস সাইট ও স্থাপনাসমূহের মালিকের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ভাড়া কমানো- শেয়ারড সাইটগুলোর মধ্যে যেখানে পোল-টাইপ বিটিএস রয়েছে সেখানে বাড়ির মালিকের সাথে পৃথক চুক্তি করে খরচ কমিয়ে আনা।- দৈনন্দিক দাপ্তরিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ অটোমেশনের আওতায় এনে কাজের গতি বৃদ্ধি এবং জনবলের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত।
২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর যৌথ মূলধনী কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধিত হলেও দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল নেটওয়ার্কের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৫ সালের ৩১শে মার্চ। টেলিটক সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল– পাবলিক সেক্টর হতে জনগণকে মোবাইল টেলিফোন সেবা প্রদান করা।- পাবলিক সেক্টর এবং প্রাইভেট সেক্টরের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করা।- মোবাইল টেলিফোনের যে উচ্চ চাহিদা রয়েছে, তার একটা অংশ পূরণ করা।- সরকারের জন্য রাজস্ব আহরণের নতুন একটি উৎস তৈরি করা।

বেসরকারি মোবাইল টেলিফোন অপারেটরদের সাথে সুষম প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি ও টেলিকম সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি মালিকানাধীন অপারেটর হিসেবে দেশের জনগণকে মোবাইল সেবা প্রদান শুরু হয়। টেলিটকের আগমনে মোবাইল কলরেট গ্রাহকদের ক্রয়সীমার মধ্যে আসে এবং এখনও টেলিটকের উপস্থিতি গ্রাহকদের স্বল্প খরচে আধুনিক ভয়েস ও ড্যাটা সার্ভিস প্রদানে টেলিটক ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক এলাকায় যথা: উত্তরে নেত্রকোনা-সুনামগঞ্জ, পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম-বান্দরবান-খাগড়াছড়ি এবং দক্ষিণে সুন্দরবন এলাকায় টেলিটক নেটওয়ার্ক স্থাপন করে মোবাইলসেবা প্রদান করছে।
২০০৫ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পর ২০১১ সাল পর্যন্ত টেলিটকে নতুন কোন বিনিয়োগ হয়নি। ফলে সে সময়েই টেলিটক পিছিয়ে পড়ে। কোনো বিনিয়োগ না হওয়ায় যথাসময়ে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় সরকারি বিনিয়োগ, প্রযুক্তি পরিবর্তন/আপগ্রেডেশন এবং ধারাবাহিক বিনিয়োগের অভাবের কারণে সৃষ্ট অপ্রতুল নেটওয়ার্ক কভারেজ টেলিটকের দুরবস্থার অন্যতম কারণ। এরই ফলশ্রুতিতে টেলিটক দুর্বল নেটওয়ার্ক-এর কারণে সন্তোষজনক গ্রাহকসেবা প্রদান করতে না পারায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাড়ানোর জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে। এখানে উল্লেখ্য যে, টেলিটকের বিটিএস আছে ৫ হাজার ৬৬১টি। যেখানে গ্রামীণফোনের ১৮ হাজার এবং রবির সাড়ে ১৫ হাজার বিটিএস রয়েছে। সংখ্যা বিচারে মার্কেট লিডার গ্রামীণফোনের তুলনায় টেলিটক এর বিটিএস ৩১% এবং রবির তুলনায় ৩৭%।
মোবাইল ফোন মার্কেট লিডার (জিপি)-এর তুলনায় এক দশমাংশ বিনিয়োগ যা দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক কভারেজ নিশ্চিতে অত্যন্ত অপ্রতুল। টেলিটকের বিনিয়োগ বর্তমানে ৫০০০ কোটি টাকারও কম যেখানে জিপি’র বিনিয়োগ প্রায় ৪২,০০০ কোটি টাকার অধিক। মোবাইল সেবা প্রদানে অপারেটরদের ব্যবসায় মোবাইল কভারেজই মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাই নেটওয়ার্ক কভারেজের অপ্রতুলতা স্বভাবতই রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
প্রয়োজনীয় প্রকল্প সহায়তা না পেয়ে টিকে থাকার স্বার্থে টেলিটক নিজস্ব আয় থেকে অদ্যাবধি প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। যার ফলে প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহীত সরকারি ঋণ পরিশোধ, বিটিআরসির পাওনা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে টেলিটকের দায় তৈরি হয়েছে। সার্বিকভাবে নেটওয়ার্কের দুর্বলতার কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আয় না হওয়ায় দায় পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এতৎসত্ত্বেও, টেলিটক ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিমাণে এবং নির্বাচনকালীন ও অন্যান্য সময়ে সরকারি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে। সরকারের ই-সেবাসমূহ (recruitment, school/college admission, result publication etc) জনসাধারণের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিচ্ছে। ২০১৯-২০২১ সালে করোনাকালীন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের পর্যবেক্ষণের কাজে একমাত্র সরকারি টেলিটক কোম্পানি সরকারের করোনা প্রতিরোধ কর্মসূচিকে সফল করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। সরকারি কর্মসূচি জনবান্ধব কিন্তু ব্যবসাবান্ধব নয় বিধায় বেসরকারি অপারেটরসমূহ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে দ্বিধান্বিত থাকে। টেলিটক প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখছে। ভ্যাট, ট্যাক্স বাবদ এ যাবৎ (৩০ জুন, ২০২২ পর্যন্ত) টেলিটক সরকারি কোষগারে ১৯৮০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন রকম ফি এবং রাজস্ব ভাগাভাগির অংশ হিসেবে বিটিআরসিকে ৩০ জুন, ২০২২ পর্যন্ত ৭৫৪ কোটি টাকা প্রদান করেছে। উল্লেখ্য টেলিটক এ যাবৎ নিজস্ব আয় থেকেই পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করে আসছে।