১৭ বছরেও অন্যান্য মোবাইল কোম্পানীর ধারে কাছেও যেতে পারেনি টেলিটক

লাস্টনিউজবিডি, ২৭ জানুয়ারি: অব্যাহত লোকসান এড়াতে একমাত্র সরকারি খাতের মোবাইল কোম্পানী টেলিটক সল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে শেষবারের মত চেস্টা চালিয়ে যাচ্চেন বলে জানা গেছে। বর্তমান ডাক ও টেলিযোযোগাগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার দায়িত্ব নেয়ার পর ৫ হাজার কোটি টাকা নতুন ভাবে বিনিয়োগ করলেও আশানুরুপ ফল দেখাতে পারেনি টেলিটক প্রসাশন ।
নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও অন্যান্য মোবাইল কোম্পানীর ধারে কাছেও যেতে পারেনি সরকারিখাতের এই মোবাইল কোম্পানী । যা নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং আইটিখাতের অভিঞ্জজনরা ক্ষোভ করেছেন ।

নানা সূত্রে প্রকাশ , ২০০৫ সালে ৩১ মার্চ টেলিটকের যাত্রার পর থেকে বেসরকারি এই মোবাইল কোম্পানীর এক শ্রেনীর কর্মকর্মকর্তারা ছলে বলে কুট কৌশলে নানা প্রলোভনে টেলিটকের গতি স্থবির করে রেখেছে। তার মধ্যে রয়েছে নানাবিধ দুর্নীতী । এমডি আসে এমডি যায়। যার যার মত বানিয়ে চলে যায়। বাড়িয়ে যায় দায়-দেনা। পকেট ভারি করে এক সময় তিনি নাই ।
এবার দেখা যাক নয়া এমডি প্রকৌশলৗ এ কে এম হাবিবু রহমান কি করেন। কর্মজীবনে ব্যক্তিসার্থের উর্ধে থেকে যিনি দাযিত্ব পালন করেছেন তাঁর নাম এ কে এম হাবিবুর রহমান । একজন সৎ ,বিনয়ী নম্র ,ভদ্র পরিশ্রমী দায়িত্ব পরায়ন এই কর্মকর্তার হয়ত শেষ চ্যালেঞ্জ টেলিটক । এর আগে তিনি সাবমেরিন কেবল, বিটিসিএলে ছিলেন । তাঁর কর্মজীবন শেষ হবে ২০২৪সালে ।
জানা গেছে টেলিটকে কাজের গতি আনতে ই-নথি জোরালোভাবে চালু করেছেন তিনি। সকলের কর্মকান্ড সদা-মনিটর করছেন। ইতোমধ্যে ই -নথি দেখে সিদ্দান্ত দিতে বিলম্ব করায় শোকজ করা শুরু করেছেন। এটা প্রথম সতর্কতা। তবে দুর্নীতিবাজ সেন্ডিকেটদের সাথে কতদুর পেরে উঠেন এটা এখন দেখার বিষয় । টেলিটকে লোকসানের জন্য জবাবদিহি নেই। লোকসান হলে কোম্পানি পরিচালনার সঙ্গে যুক্তদের কোনো ক্ষতি হয় না। পাশাপাশি টেলিটক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নজরদারি, পরিকল্পনার অভাবসহ নানা কারণে এটি সফল হতে পারেনি।
বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে ২০০৫ সালের ৩১ মার্চ। টেলিটকের ওয়েবসাইটে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের প্রতিটি কোনায় প্রতিটি মানুষকে সবচেয়ে সাশ্রয়ী সেবা দেওয়া। সরকারের রাজস্বের নতুন উৎস হিসেবে কাজ করা এবং বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করাও টেলিটকের উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) গত অক্টোবর মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মুঠোফোনের সক্রিয় সিমসংখ্যা এখন ১৮ কোটির বেশি। গ্রামীণফোনের ৮ কোটি, রবির সাড়ে ৫ কোটি ও বাংলালিংকের প্রায় ৪ কোটি গ্রাহক থাকলেও টেলিটকের গ্রাহক ৬০ লাখ ৭৫ হাজার, যা মোট গ্রাহকের ৪ শতাংশের কম।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে টেলিটকের সিম ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আবার সরকারি কিছু সেবা নিতে টেলিটকের সিম থাকতে হয়। যেমন সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে আবেদন। এসব কারণে অনেকে টেলিটকের সিম রাখেন।
প্রতিষ্ঠার পর ১৭ বছরেও টেলিটক দেশের বড় একটি অংশকে নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে পারেনি। কোম্পানিটি জানিয়েছে, দেশের ৬১ শতাংশ এলাকা টেলিটকের দ্বিতীয় প্রজন্মের (টু–জি) নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। যেসব এলাকায় শুধু টু–জি নেটওয়ার্ক রয়েছে, সেখানে মানুষ ফোনে শুধু কথা বলা ও খুদে বার্তা পাঠাতে পারে। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য দরকার হয় থ্রি–জি ও ফোর–জি নেটওয়ার্ক।
দেশের ৫০ শতাংশ এলাকা টেলিটকের থ্রি–জি ও ৩২ শতাংশ এলাকা ফোর–জির আওতাভুক্ত। কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত কিছু বড় শহরে টেলিটক দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে পেরেছে। অনেক শহরে সেটাও পারেনি। যেমন লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জে টেলিটকের ফোর–জি সেবা নেই। ঢাকার ২০ শতাংশ এলাকাও এই সেবার বাইরে। যদিও ফোর–জি সেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি অপারেটরগুলো বহুদূর এগিয়ে গেছে।

নেটওয়ার্কের আওতা বাড়াতে দরকার বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস), যা টাওয়ার নামে পরিচিত। টেলিটকের বিটিএস আছে ৫ হাজার ৬৬১টি। যেখানে গ্রামীণফোনের ১৮ হাজার এবং রবির সাড়ে ১৫ হাজার বিটিএস রয়েছে।
টেলিটকের লোকসান ধারাবাহিক। ১৭ বছরে তারা মাত্র দুই অর্থবছরে মুনাফার মুখ দেখেছিল। টেলিটকের দেওয়া হিসাব বলছে, ২০২১–২২ অর্থবছরে সেবা বিক্রি করে তাদের আয় ৪৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু পরিচালন ব্যয় এত বেশি যে নিট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৫ কোটি টাকার বেশি। বিগত তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বশেষ অর্থবছরে লোকসান বেশি হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেলিটকের দেনা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সরকারের পাওনা প্রায় ২ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। বিটিআরসির পাওনা আরও ১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বিদ্যুৎ বিল হিসেবে পায় ৩৮৯ কোটি টাকার বেশি। শুধু সরকার নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও টেলিটকের দেনা রয়েছে। এর মধ্যে সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পায় ১৬৬ কোটি টাকা। ব্যাংক ও অন্য ঋণদাতারা পায় ১৯৪ কোটি টাকার মতো।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) গত আগস্ট মাসে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সক্ষমতা বাড়াতে ২ হাজার ২০৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে টেলিটক ৫০০টি নতুন টাওয়ার বসাবে। পাশাপাশি অন্য অপারেটরদের সঙ্গে ভাগাভাগির মাধ্যমে আড়াই হাজার টাওয়ার বাড়াবে।

নতুন করে ৩ হাজার টাওয়ার যোগ হলেও অন্যদের চেয়ে পিছিয়েই থাকবে টেলিটক। কারণ, টেলিটকের টাওয়ার দাঁড়াবে সাড়ে ৯ হাজারের মতো। এখন গ্রামীণফোনের ১৮ হাজারের বেশি ও রবির ১৫ হাজারের বেশি টাওয়ার রয়েছে। সংখ্যা বাড়ছেও। অপারেটরগুলো আগামী এক–দুই বছরের মধ্যে ফাইভ–জি চালুর চিন্তা করছে। টেলিটক ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভ-জি পরীক্ষা চালিয়েছে। কয়েকটি জায়গায় এ সুবিধা চালু হয়েছিল। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সুবিধা এখন বলার মতো অবস্থায় নেই।
রাজধানীতে টেলিটক ফাইভ-জি চালু করতে ২৩৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু সরকার প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়নি, গত আগস্টে ফিরিয়ে দেয়।
এদিকে সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা যায়, সহজে টেলিটকের সিম পাওয়া যায় না। রিচার্জ পয়েন্টও অনেক কম। নেটওয়ার্কের অবস্থাও ভালো নয়। এসব কারণে গ্রাহকদের টেলিটক থেকে আগ্রহ কমে গেছে ।
পাওনা পরিশোধে এরই মধ্যে টেলিটককে চিঠি দিয়েছে বিটিসিএল। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. রফিকুল মতিন বলেন, আমরা টেলিটকের কাছে ৮৩ কোটি টাকা পাবো। তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে টেলিটকের কাছে তরঙ্গ বাবদ পাওনা টাকার প্রথম কিস্তির ১০০ কোটি টাকা চেয়েছে বিটিআরসি। বিটিআরসির অর্থ হিসাব বিভাগ থেকে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে গত ১ আগস্ট একটি চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছে বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠি মোতাবেক ২ হাজার ৬শ মেগাহার্জ ব্যান্ডের তরঙ্গ বরাদ্দ ফি-২০২২ এর প্রথম কিস্তির ১০ শতাংশ বাবদ অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর্তনপূর্বক ৯৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭০১ টাকা এবং মূসক বাবদ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ৭৭ কোটি ৫ লাখ ৩ হাজার ৩০৮ টাকাসহ মোট ১০০ কোটি ৭৫ লাখ ৪৩ হাজার ৯ টাকা অনতিবিলম্বে ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য বিলম্ব ফিসহ পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
বিটিআরসির এক কর্মকর্তা জানান, তরঙ্গ বরাদ্দের জন্য গ্রামীণফোন ও রবি প্রথম কিস্তি পরিশোধ করেছে। বাংলালিংক প্রথম কিস্তির জন্য ১৫ শতাংশসহ পরিশোধের শর্তে এক বছর সময় নিয়েছে। তবে টেলিটক (এখনো পরিশোধ করেনি। এজন্য টেলিটককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ফোনের সংযোগে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন। তাদের সংযোগ সংখ্যা ৮ কোটি ৭৫ লাখ। রবির রয়েছে ৫ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার সংযোগ, যা দ্বিতীয় স্থান। অন্যদিকে বাংলালিংক আছে তৃতীয় স্থানে। তাদের সংযোগ সংখ্যা ৩ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার। টেলিটকের সংযোগ সংখ্যা মাত্র ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার।