অটোমোবাইল শিল্প দাঁড়াতে আরও কিছুটা সময় লাগবে: হাফিজুর রহমান খান

লাস্টনিউজবিডি, ১৪ জানুয়ারি: ‘যেকোনও খাতের একটি শিল্পকে পুরোপুরি দাঁড় করাতে হলে চ্যালেঞ্জ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ধাপে একধরনের চ্যালেঞ্জ থাকবে। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে ওই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই সামনের দিকে যাচ্ছি। যেমন আজ থেকে পাঁচ বছর আগে অটোমোবাইল পলিসি ছিল না। ওই সময়ে গাড়ি উৎপাদনে প্রণোদনার ব্যবস্থা ছিল না।’
‘এখন প্রণোদনা আসছে, ভ্যাট-ট্যাক্সের সুবিধা আসছে। এমনকি (ইলেকট্রিক) রেজিস্ট্রেশনেও বাড়তি সুবিধা থাকবে। পুরো শিল্প দাঁড়াতে সময় লাগবে। যত সময় যাবে, ততই প্রতিবন্ধকতা দূর হবে।’

গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শিল্প মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার’ গ্রহণের পর রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান এসব কথা বলেন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ‘রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার’-এর বহৎ শিল্প ক্যাটাগরিতে যৌথভাবে প্রথম পুরস্কার পায় রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড। শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের কাছ থেকে রানার গ্রুপের পক্ষে এই পদক গ্রহণ করেন চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান।
তিনি বলেন, ‘যেকোনও পুরস্কার প্রাপ্তি আনন্দের ও গৌরবের, অহংকারের। তবে এই প্রাপ্তি দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। এ পুরস্কার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, আমাদের আরও অনেক দূরে যেতে হবে। আমরা আমাদের কোম্পানির সবাইকে নিয়ে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। নিশ্চয়ই আমরা সফল হবো।’
হাফিজুর রহমান খান আরও বলেন, ‘আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই ফোর হুইলার উৎপাদনে যাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমাদের পরিকল্পনা এবং উৎপাদিত যান দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় বিশেষ অবদান রাখবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বে অটোমোবাইলে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। স্পেয়ার পার্টসের বাজার প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার।’ এসব বাজারে তাদের প্রবেশ করতে হবে বলে জানিয়েছেন হাফিজুর রহমান খান।
সরকারি সহায়তার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেখানে গার্মেন্টস খাতের মতো প্রসার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। যার মধ্যে রয়েছে বন্ডেড ওয়্যার হাউস ও রফতানি প্রণোদনার মতো সুবিধা।’ এর মাধ্যমে অল্প দামে বিশ্ব মার্কেটে প্রবেশ করা সহজ হবে বলেও জানান তিনি।

ইলেট্রিক্যাল ভেইক্যাল দিয়ে প্যাসেঞ্জার গাড়ির যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার যে অটোমোবাইল নীতিমালা ঘোষণা করেছে, সেখানে দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য নগদ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। মোটরসাইকেল যেভাবে ধাপে ধাপে এগিয়েছে, ইলেকট্রিক্যাল গাড়ির বিষয়টিও ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে। রিকন্ডিশন গাড়ির ব্যবহার যখনই সীমিত হয়ে আসবে, তখনই নতুন গাড়ি আমদানি ও উৎপাদনের দরজা উন্মুক্ত হবে।’
রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা আমদানিকে নয়, রফতানিপ্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে চাই। এর জন্য দেশীয় পণ্য উৎপাদনকে সহায়তা দেওয়ার কথা বলছি। সে জন্যই অটোমোবাইল শিল্প খাতের বিকাশে আমরা প্রণোদনা চেয়েছি। এই খাতে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা পেলে রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের অবদান রাখবে। সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি জানান, ‘এই মুহূর্তে এই খাতের জন্য আমরা ২০ শতাংশ হারে রফতানি প্রণোদনা চাচ্ছি। শুরুতে প্রণোদনার এই হার বেশি মনে হলেও এর জন্য বেশি টাকা লাগবে না, কারণ আমাদের ভলিয়ম তো কম। পরে যখন ভলিয়ম বাড়বে, তখন এই হার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা যেতে পারে।’
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের জন্য সরকারের বহৎ শিল্প ক্যাটাগরিতে যৌথভাবে প্রথম পুরস্কার পায় রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। শিল্প খাতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ও বেসরকারি খাতে শিল্প স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ‘রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার-২০২০’ দেওয়া হয়।

বিশ হাজার টাকা দিয়ে শুরু, হাফিজুর রহমান আজ ২৫ হাজার কোটি টাকার মালিক
ব্যবসা করতে পুঁজি লাগে, তাই বাবা চাইতেন ছেলে তার মতো চাকরি করবে। বারো জন ছেলে-মেয়ের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো বাবা কোরেশ আলী খানকে। পরিবারের কিছুটা দায়িত্ব নিজের কাধে নিতে হাফিজুর রহমান লেখাপড়া শেষে চাকরি করলেও তাতে মন বসাতে পারেননি। ছোট থেকেই হাফিজুর রহমান খান ছিলেন স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন দেখতেন দেশে একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হবেন। তাই চাকরি ছেড়ে নেমে পড়েন ব্যবসায়। স্বপ্নবাজ এ হাফিজুর রহমান আজ সফল একজন উদ্যোক্তা। গড়ে তুলেছেন রানার গ্রুপ।
পুঁজি কম থাকলেও হাফিজুর রহমানের ছিল অসাধারণ মেধাশক্তি ও পরিশ্রম করার দৃঢ় মানসিকতা। ব্যবসার জন্য তিনি কি না করেছেন। দিন-রাত ছুঠেছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। তার সেই পরিশ্রমের ফসল রানার মোটরসাইকেল আজ ছুটছে শহর থেকে গ্রামে। মটরসাইকেলের সাথে সাথে বর্তমানে রানার গ্রুপের যানবাহনগুলোও দেশের বাজারে পরিচিত নাম। দেশের অটোমোবাইল বাণিজ্যে সুনাম কুড়িয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে রানার মোটরসাইকেল।
মোটরসাইকেল দিয়ে শুরু করে রানার এগ্রো কোম্পানি, রানার অটো ব্রিকস ফিল্ড, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রানার সিসটেমস লিমিটেড, রানার প্রোপার্টিজ ও রানার মোটরস লিমিটেড নামে বেশ কয়েকটি কোম্পানির মালিক হাফিজুর রহমান। সফল এ ব্যবসায়ী আজ তরুণ উদ্যোক্তাদের মডেল।
১৯৫৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। বাবা মরহুম কোরেশ আলী খান ও মাতা মরহুমা পরিজান নেসার ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে শিশু হাফিজুর রজমান। রাজশাহীতে জন্ম নিলেও পৈত্রিক নিবাস ছিলো নওগাঁয়। বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় শৈশব কাটে দেশের বিভিন্ন জেলায়। নওগাঁর থেকে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহীতে ভর্তি হওয়ার পরই সফল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন হাফিজুর রজমান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে শুরু করেন কর্মজীবন। পুঁজি না থাকায় প্রথমে ব্যবসা করা আর হয়ে ওঠে না। তবুও হাল ছাড়ে দেননি তিনি।
প্রথম কর্মজীবনে হাফিজুর রহমান খান একটি পাঠকলে চাকরি নেন। এই চাকরি ছেড়ে যোগদেন শ্যালো মেশিন ও পাম্প বিক্রয়কারী একটি প্রতিষ্ঠানে। এই চাকরি মাধ্যমে শিখতে থাকেন ব্যবসার নানা বিষয়। ১৯৮৩ সালে শেষের দিকে চাকরি ছেড়ে নেমে পড়েন ব্যবসায়। সেই সময় তার মূলধন ছিল মাত্র ২০ হাজার টাকা। পুঁজি যথেষ্ট না থাকলেও তিনি মেধাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন নিজের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
অংশদারিত্বের ভিত্তিতে তিনজন মিলে শুরু করেন ব্যবসা। এই ব্যবসায় তার ছিলো মেধাশক্তি। এরপর ২০০০ সালে গড়ে তোলেন রানার অটোমোবাইলস। আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেন দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত মোটরসাইকেল ব্যবসায়ীদের। তার ব্যবসার পরিকল্পনা ও উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে এসব ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করেন তার ব্যবসায়। ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে পুরোদমে নেমে পড়েন ব্যবসায়। ব্যবসার শুরুতে চায়না থেকে মোটরসাইকেল আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি করতেন। এর পাশাপাশি ট্রাক, বাস দেশের বাইরে থেকে এনে বিক্রয় শুরু করেন। যখন রানার অটোমোবাইলস পুরোপুরি সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠে তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন দেশের আবাসন খাতকে নিয়ে। গড়ে তুলনে রিয়েল এস্টেট ও ব্রিকস কোম্পানি। এরপর আরো গড়ে তোলেন কিছু প্রতিষ্ঠান। এভাবে মেধা, বুদ্ধি, পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠা করেন রানার গ্রুপ।
এখন সেই রানার গ্রুপ নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। সফল এ উদ্যোক্তা জানান, অটোমোবাইলস খাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অটোমোবাইলস খাতের পণ্যগুলো বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি আরো দৃঢ় করা সম্ভব। এ শিল্প খাতের পণ্য বিশ্ববাজার দখলে সক্ষম হবে এবং দেশের চেয়ে বিশ্ববাজারে রফতানির সম্ভাবনা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তিনি তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তরুণ উদ্যোক্তারা এ খাত উন্নয়নে এগিয়ে আসলে এই শিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশে সুনাম বয়ে আনবে।
