শোকের মাসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর নিয়ে কিছু কথা

বাংলাদেশে আগস্ট শোকের মাস। এ মাসে বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ১৯৭৫ সালে এ মাসের ১৫ তারিখে বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ধানমন্ডির যে ৩২ নম্বর বাড়িতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল, স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর সে বাড়িতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে তারই প্রতিশোধ নেওয়া হয়।
এই আগস্ট মাস আরও দুটি কারণে স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধে চীন শুধু বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেনি, পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছিল বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে গুঁড়িয়ে দিতে। ৩০ লাখ শহীদের প্রত্যেকের শরীর বহন করেছে চীনা বুলেট কিংবা তাদের মদদে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংস অস্ত্রাঘাতে হত্যার চিহ্ন। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসের ৮ তারিখে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদন জানায়। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১১ সদস্য দেশ পক্ষে ভোট দেয়, ৩ দেশ বিরত থাকে, একমাত্র চীন ভেটো দেয়। তারিখটি ছিল ২৫ আগস্ট। দি নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘চায়নাস ফার্স্ট ইউ এন ভেটো বারস বাংলাদেশ’ শিরোনামে খবরটি প্রকাশ করেছিল পরদিন। ২৬ আগস্টের পত্রিকায় এই ভাবে খবরটি শুরু হয়েছিল, ‘জাতিসংঘ নিউ ইয়র্ক, আগস্ট ২৫- সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের কঠোর সমালোচনার পর পিকিং সরকার বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত করতে আজ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম ভেটো প্রদান করে।’
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ৩১ আগস্ট চীন স্বীকৃতি দেয়। এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না, বঙ্গবন্ধু নিহত না হওয়া পর্যন্ত চীন স্বীকৃতির অপেক্ষায় ছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, যার জন্য বাঙালি জাতি শোকের মাস পালন করে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান এবং বাংলাদেশ জাতির পিতার হত্যাকারীদের শাসনে যাওয়ার পর স্বীকৃতির এই বেদনাবিদূর ত্রয়ী ঘটনার আগস্ট মাসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশ সফরে আসছেন। কোনো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। ‘বিশেষ খবর’ হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু ওয়াং-এর এই সফর ‘বিশেষ খবর’ হয়েছে। বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঢাকা সফরের পরিকল্পনাকে ‘অ্যাগ্রেসিভ প্ল্যান’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি একইসঙ্গে জানান, বেইজিং-এর এ ধরনের পরিকল্পনায় বিব্রত ঢাকা। খবরে আরও বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করেই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর বাংলাদেশ সফরের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলে ঢাকায় চীনের দূতাবাস। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো আগাম অনুমতি বা সম্মতি নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন খোদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
বার্তা সংস্থার খবরে আরও বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী বলেন, তারা ডেসপারেটলি এই সফর চায়। চীনা দূতাবাস আমাদের সঙ্গে আলাপ না করেই এই সফরের দিনক্ষণ ঠিক করে। তারপর তারা তা জানাতে এসেছিল। আমরা তাদের বলেছি, এই সময়ে আমি দেশে থাকছি না। যুক্তরাষ্ট্রে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও শান্তিপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যবহার বাড়ানো বিষয়ক এক সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে ওই সময় কম্বোডিয়ার নমপেনে আসিয়ানের একটি বৈঠকে অংশ নেব। আমি বলেছি, যেহেতু ওই সময়ে আমি দেশে থাকছি না, তাই তাদেরকে সফরসূচি পেছাতে হবে। পরের যে কোনো সময়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবে ঢাকা।
যাহোক শেষ পর্যন্ত সফরসূচি পরিবর্তন করে নির্ধারিত হয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মিত্র বলে কথা। তবে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘অ্যাগ্রেসিভ’এই সফর সম্পর্কে খবরে ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে, ওয়াং ই-এর এই ঢাকা সফরের পরিকল্পনা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারত মহাসাগরীয় কৌশল বা আইপিএফ ও চারদেশীয় নিরাপত্তা জোট কোয়াড-এ বাংলাদেশ যাতে অংশ না নেয় সে বিষয়ে চীনের পক্ষ থেকে পুনরায় অনুরোধ জানানো হতে পারে। এর পরিবর্তে ঢাকা-বেইজিং সহযোগিতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারেন ওয়াং ই। বেইজিং আগে থেকেই এসব জোটে ঢাকার অংশগ্রহণ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। আবার কোনো কোনো বিশ্লেষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এভাবে ঢাকা সফরের পরিকল্পনাকে বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আগামি মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের কথা রয়েছে।
শোকের মাস আগস্টে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ‘অ্যাগ্রেসিভ’ সফর, অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাই পেছন ফিরে তাকাতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের অভ্যুদয়, সে দেশ রক্তাক্ত অধ্যায় ভুলতে পারে না, ভুলে যেতে পারে না এই নারকীয় অধ্যায়ের পেছনে কারা ছিল। আমাদের জাতির জনকের স্বাধীনতার স্বপ্ন কারা গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল আমরা জানি, এও জানি কাদের মদদে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। বিতাড়িত হয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল এক কোটিরও বেশি বাঙালি। ত্রিশ কোটি বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার মাটি, ধর্ষিত-অত্যাচারিত হয়েছিল কয়েক লাখ নারী। তাদের মধ্যে অনেকেই লজ্জায় ঘৃণায় আত্মহননের পথ বেছে নেন। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতির এই দুর্দিনে ভারত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় বিশ্ব বিবেক জানতে পেরেছিল বাংলাদেশে কী ঘটেছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গোড়া থেকে অস্বীকার করে আসছিল সবকিছু, আর পেছনে দাঁড়িয়ে এই অমানবিক নৃশংস পদক্ষেপকে সমর্থন করছিল চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আমরা ভুলতে পারি না, বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পাকিস্তানি হানাদার জান্তা বিচারের নামে প্রহসন করে তাঁকে যখন হত্যার চেষ্টা করছিল, কবর খুঁড়ছিল এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এই ষড়যন্ত্র বন্ধ ও বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ে বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দৌড়ঝাঁপ করছিলেন, চীনের পিপলস ডেইলিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এই সফর নিয়ে বিদ্রæপ করা হচ্ছিল। অন্যদিকে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকলেও সেদেশের সংবাদপত্র সেদিন মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্বে সময় ও পরিস্থিতি অনেক কিছু বদলে গেলেও বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে যেসব দেশ আমাদের গণহত্যার পক্ষে দাঁড়িয়েছে এবং স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তাদের ক্ষমা করা কঠিন। শোকের মাসে হৃদয়ে রক্তক্ষরণটা আরও বেশি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি সাংবাদিক-লেখক শাহরিয়ার কবির এ ব্যাপারে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যারা বিরোধিতা করেছে, বাঙালি জাতির পিতার হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুমোদন করেছে, শোকের মাসে বাংলাদেশ তাদের দেখতে চায় না। শোকের মাসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন, যে চীন বঙ্গবন্ধু হত্যা অনুমোদন করেছে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তিনি আরও উল্লেখ করেন, চীন এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতার জন্য ক্ষমা চায়নি, যেমন চায়নি পাকিস্তান।
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমেদ মানিক বঙ্গবন্ধু হত্যায় চীনেরও হাত ছিল এই অভিযোগ করে এই লেখককে বলেন, ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান যখন চীন সফরে যান, চীনা নেতারা তাকে এই বলে অভিনন্দিত করেছিলেন যে, তিনি দেশকে রক্ষা করেছেন। শোকের মাসে আমরা বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধী কাউকে চাই না। বিচারপতি মানিক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই শোকের মাসটাই সফরের জন্য বেছে নিল, যা আমরা চাই না। চীনের উদ্দেশ্য হলো, বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্প বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ঋণের ফাঁদে ফেলা। শ্রীলংকাকে তাই করেছে। কদিন আগে নেপালে গিয়েছিল, নেপাল সতর্ক হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
রাজনীতির পরিক্রমায় চীন অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়েছে, সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বেড়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এই দেশটি স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বই চায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের ভয়াবহতম গণহত্যা ছাড়াও আমাদের জাতির পিতার হত্যাকান্ডের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে তাদের নাম এসে যায়। সহযোগিতার নামে হাত বাড়ানো চীন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ উদ্বেগ-শঙ্কার নাম। মুক্তিযুদ্ধের পর ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ কি থেমে যাবে ? শোকের মাস তো আরও বেশি কান্নার।
বাসুদেব ধর- সাংবাদিক-লেখক
*প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য লাস্টনিউজবিডি কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।