অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের চার্জ গলার কাঁটা

লাস্টনিউজবিডি, ২৫ জুলাই: এপিআর এনার্জি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দেশের অন্যতম বড় ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে আসে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ বিধানে দরপত্র ছাড়াই ঢাকার কেরানীগঞ্জে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা বছরে সর্বোচ্চ ২১৬ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কেন্দ্রটি থেকে মাত্র ৩৪ লাখ ৪৮ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ কেনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), যা সক্ষমতার ১ শতাংশেরও কম।
পরের ২০২০-২১ অর্থবছরে কেনা হয় ৭ কোটি ২১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ, যা সক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ। বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী সরকার ক্যাপাসিটি চার্জের (বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও অর্থ উদ্যোক্তাদের টাকা পরিশোধ) নামে এপিআর এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডকে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে যথাক্রমে ৫৩৩ ও ৫২৬ কোটি টাকা দিয়েছে। গত অর্থবছরের (২০২১-২২) জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত বিদ্যুৎ না কিনেও এই কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের দিতে হয়েছে ৪০১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৩৩ মাসে বিদ্যুৎ কেনার বিলের বাইরেও ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা এপিআর এনার্জিকে দিয়েছে পিডিবি।
গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমের চাহিদার কথা বলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এপিআর এনার্জিসহ এক হাজার মেগাওয়াটের পাঁচটি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এই কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে সক্ষমতার মাত্র ৪-৫ শতাংশ। অনুমোদন প্রক্রিয়ার সময়ই খাতসংশ্নিষ্টরা এই কেন্দ্রগুলোর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন না থাকলেও ব্যয়বহুল ডিজেল কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যা বিদ্যুৎ খাতে বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’
এভাবে অপরিকল্পিতভাবে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন, অযোগ্য কোম্পানিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প দেওয়া, প্রতিযোগিতা ছাড়া অতিরিক্ত দরে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি এবং স্বল্প মেয়াদের রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে বিদ্যুৎ খাতে বছর বছর খরচ বাড়ানো হয়েছে। শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে গত ১১ বছরে (২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর) বেসরকারি খাতে ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। এর মধ্যে ১২ কোম্পানির পকেটে গেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে তিনটা অংশ থাকে- জ্বালানি খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় এবং ক্যাপাসিটি চার্জ। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তিতেই ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টি রাখা হয়। ক্যাপাসিটি চার্জ মূলত যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে ধরা হয়। তিনি বলেন, কিছু কিছু সময় বিদ্যুতের চাহিদা গড় চাহিদার চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। এই বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রিজার্ভ রাখতে হয়। এই কেন্দ্রগুলো যখন বসে থাকবে, তখন শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে। এখন উৎপাদন সক্ষমতার কত অংশ রিজার্ভ রাখা হবে, তার হিসাব-নিকাশ করতে হবে। এটা কোনোভাবেই অতিরিক্ত হওয়া যাবে না। দেখা যাচ্ছে, দেশে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র সারাবছর বসে থাকে বা মাত্র ৮-১০ দিন চলে। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৩০০-৪০০ কোটি টাকা নিচ্ছে। এটা তো অযৌক্তিক।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা শাখা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের যে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে, তা প্রয়োজনের জন্যই স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বের অন্য দেশের রিজার্ভ সক্ষমতা আরও বেশি। তিনি বলেন, ক্যাপসিটি চার্জ বিদ্যুৎ ক্রয়ের একটা অংশ; এটা কোনো বাড়তি খরচ নয়। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থাকছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন যেগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে, সেগুলো বিদ্যুৎ বেচলেই টাকা পাবে; কোনো অতিরিক্ত ব্যয় হবে না।
অদূরদর্শী পরিকল্পনা: বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের একাধিক সাবেক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্র ছাড়াই অনুমোদন পেয়েছে। প্রথমদিকে কাজ পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের কিছু যোগ্যতা রাখা হয়েছিল, যাতে দক্ষ কোম্পানি কাজ পায়। পরে ওপরমহলের চাপে সেসব শর্ত শিথিল করতে হয়। এতে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ফার্নিচার, লবণ, সিমেন্ট ব্যবসায়ীরাও এ খাতে ব্যবসায় নেমে পড়েন, যা বিদ্যুৎ খাতে ডেকে এনেছে বিপর্যয়।
তাঁরা আরও বলেন, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য। এ জন্য প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছিল। মেয়াদ বেশি ধরলে এই দর কম হতো। পরে সব কেন্দ্রের মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানো হয়। তিন থেকে পাঁচ বছরের বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০-১২ বছর ধরে ব্যবসা করছে। তবে বিদ্যুতের দাম খুব বেশি কমেনি। এ ছাড়া চুক্তির সময় অনেক কেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর বেশি করে ধরা হয়েছে, যা বিদ্যুতের দরকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
সাবেক কর্মকর্তারা আরও জানান, বছরভিত্তিক চাহিদা প্রক্ষেপণে ভুল হয়েছে। চাহিদার অতিরিক্ত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থেকেই টাকা নিয়ে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বাড়তি সক্ষমতা সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অব্যবহূত থাকছে।
অদূরদর্শী পরিকল্পনার আরেকটি উদাহরণ হিসেবে তাঁরা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে গেলেও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিদ্যুৎ না দিলেও ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে পায়রা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।
আসছে আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাড়বে অলস খরচ: বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যেই আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৫টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরেই তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসতে পারে। নির্মাণাধীন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতের রয়েছে ৯ হাজার মেগাওয়াট। খাতসংশ্নিষ্টরা বলছেন, এই কেন্দ্রগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ গ্যাসভিত্তিক। এখনই গ্যাস সংকটে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগামীতে গ্যাসের উৎপাদন আরও কমার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে চালু হলেও অনেক কেন্দ্রকে জ্বালানির অভাবে বসে থাকতে হতে পারে। এখনই চাহিদার অতিরিক্ত সাত হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। আগামী চার বছরে আরও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কেন্দ্র উৎপাদনে এলে বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। কারণ, চার বছরের মধ্যে চাহিদা সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট বাড়তে পারে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ না কিনেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধের অঙ্ক অনেক বেড়ে যাবে।
১২ কোম্পানির পকেটে অধিকাংশ অর্থ: গত ১১ বছরে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ না কিনেও সরকার যে ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে, এর মধ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকাই গেছে ১২টি কোম্পানির পকেটে।
পিডিবির তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে সামিট গ্রুপ। বর্তমানে সামিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর জন্য কোম্পানিটি বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল গত ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
মালয়েশিয়াভিত্তিক কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস ৮১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গত ১১ বছরে সাত হাজার কোটি টাকার ওপর ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারের কাছ থেকে নিয়েছে।
ইউনাইটেড গ্রুপ এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে নিয়েছে। বাংলাক্যাট ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। ওরিয়ন গ্রুপ ৫০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে।
হোসাফ গ্রুপ ও মোহাম্মদী গ্রুপ দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি করে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। এ ছাড়া ম্যাক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও কনফিডেন্স গ্রুপ উভয়ে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই চার্জ নিয়েছে।
বারবার বাড়ছে রেন্টালের মেয়াদ: ২০০৯ সালের দিকে ‘স্বল্প মেয়াদ’-এর নামে গ্রহণ করা হয় রেন্টাল-কুইক রেন্টাল প্রকল্প। এর পর পেরিয়ে গেছে এক যুগ। সেই আপৎকালীন ‘স্বল্প মেয়াদ’ আজও শেষ হয়নি। দুই-তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে এখনও ডজনখানেক কেন্দ্র চালু রাখা হয়েছে। নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট নামে আবারও চার রেন্টাল কেন্দ্রের মেয়াদ দু’বছর বাড়ানো হচ্ছে। গত বছর একই শর্তে ১০ কুইক রেন্টালের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়।
এ ব্যাপারে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিতেই দায়মুক্তির বিশেষ আইনে দরপত্র ছাড়াই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়া হয়েছে। বারবার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ কিনতেও দিতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ :ভারত থেকে বর্তমানে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। এ বছর আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা রয়েছে। চুক্তি অনুসারে ২৫ বছরে কোম্পানিটি ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাবে।- সৌজন্যে-সমকাল