একজন বাবাই সন্তানের সর্বোত্তম বন্ধু

।।মোঃ তারেক আজিজ খান।।
আদনান সাহেব ছেলের রুমের দরজায় কয়েকবার টোকা দিলে তার ছেলে আজিজ দরজা খুলে এবং আদনান সাহেব বললেন, কি হয়েছে বাবা, তুই এ বিকালবেলা কোথাও ঘুরতে না গিয়ে রুমের ভিতরে দরজা আটকিয়ে বসে আছিস কেনো?
আজিজ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, কোথাও ঘুরতে যাবো না বাবা, সামনে আমার ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা, তাই এ সব নিয়ে চিন্তায় আছি আর রুমে দরজা আটকিয়ে পড়ছিলাম। একথা বলেই আজিজ আবার রুমের দরজা আটকিয়ে দিল।
আদনান সাহেব বেলকনিতে বসে উনার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, আজিজ সারাদিন বাসায় বসে করে কি? ইদানীং দেখছি সারাক্ষণ রুমে দরজা আটকিয়ে বসে থাকে, কোথাও ঘুরতে যায় না বন্ধুদের সাথে, এমনকি আড্ডাতেও যায় না।
আদনান সাহেবের স্ত্রী বলল, দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা তো করে আর কি করবে? আপনারতো সবকিছুতেই বেশি বেশি, আগে বাসার বাহিরে থাকলে আপনি বকাঝকা করতেন আর এখন বাসায় থাকে বলে চিন্তা করছেন!
স্ত্রী চলে গেলে আদনান সাহেব তার ছেলেকে নিয়ে ভাবতে লাগলেন। তার ভাবনার পথ যেন গভীরে চলে যেতে লাগলো।
পরদিন সকালে আদনান সাহেব লক্ষ্য করলেন, উনার স্ত্রী আজিজকে বাজারে যেতে বলছে অথচ আজিজ বিরক্ত হয়ে বলল, আমার পড়া আছে, এখন বাজারে যেতে পারবোনা।
এইসএসসি পরীক্ষার পর থেকেই আজিজ একটু অন্যরকম হয়ে গেছে, সারাক্ষণ একা থাকে, খাওয়া-দাওয়া খুব একটা করে না, খাবার টেবিলে বসে অল্প খেয়েই উঠে যায়, মেজাজ অত্যাধিক খিটখিটে হয়ে গেছে আর চেহারার মধ্যেও একটা পরিবর্তনের চাপ দেখা যাচ্ছে।
আদনান সাহেব ছেলেকে ডেকে বললেন, আমার শরীরটা আজ ভালো না, সে কারণে আজ বাজারে যেতে পারছিনা, তুই একটু বাজারে যা না বাবা! আজিজ রাগে-ক্ষোভে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। ছেলের এমন আচরণ দেখে আদনান সাহেবের ভাবনার দরজা আরও প্রসারিত হতে লাগলো।
আদনান সাহেব ছেলের রুমে আসলেন, রুমটা বেশ সুন্দর করে ঘোচানো এবং পরিপাটি অবস্থায় আছে। ছেলের বিছানার উপরে রাখা বইটা যখন সরিয়ে টেবিলের উপর রাখলেন তখন বইয়ের ভিতর থেকে আরেকটা বই দেখতে পেলেন।
বইটা হাতে নিয়ে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। কারণ এটি ছিল অশ্লীল গল্প আর ছবি সম্বলিত ম্যাগাজিন! তিনি বইটা আবার টেবিল থেকে বিছানার উপর রেখে দিলেন, পাশে থাকা লেপটপটা অন করে কিছুক্ষণ ঘাটলেন, তারপর ছেলের রুম থেকে চুপচাপ বের হয়ে আসলেন।
সন্ধ্যার দিকে আদনান সাহেব নিজ হাতে দু’কাপ চা বানালেন। এক কাপ নিজের জন্য আর আরেক কাপ তার সন্তানের জন্য। সন্তানের দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, চল আমরা ছাদে যাই, চা খেতে খেতে বাবা-ছেলে মিলে গল্প করবো।
আজিজ কিছুটা অবাক হলো, কারণ বাবা কখনো এর আগে চা বানিয়ে আজিজকে দেয়নি। সে কিছুটা ভয়ে ভয়ে বাবার পেছনে পেছনে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেল।
ছাদে আসার পর আদনান সাহেব তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে বললেন, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম সত্য কি বলতে পারিস? আজিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক বলতে পারছিনা বাবা।
আদনান সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, জন্মালে মরতে হবে, হয় আজকে নয়তো কাল আর মরার পর কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে। এটাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম সত্য।
আমরা দিন দিন যত আধুনিক হচ্ছি, ততই পরকালের প্রতি আমাদের বিশ্বাসটা কমে যাচ্ছে। দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরা আজ ভুলে গেছি যে আমরা মুসলিম আর আমাদের আখিরাত বলে একটা জিনিস আছে। চার দেওয়ালের ভিতর তুই যদি কোনো অন্যায় করিস সেটা পৃথিবীর কেউ না দেখলেও উপরওয়ালা ঠিকই দেখছেন আর এজন্য তোকে যেমন শাস্তি পেতে হবে তেমনি আমাকেও শাস্তি পেতে হবে।
কারণ আমি আমার সন্তানকে দ্বীনের শিক্ষা দিতে পারিনি বলে। আর এটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
আজিজ কিছুটা বুঝতে পেরেছিলো, ওর বাবা কেনো ওকে এসব কথা বলছে। হঠাৎ ওর বাবা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, তোর কি কোনো পছন্দের মেয়ে আছে? থাকলে আমাকে নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় বলতে পারিস।
আজিজ মাথা নাড়িয়ে বলল, না বাবা, এরকম কিছুই নেই। আদনান সাহেব তখন চায়ে আরেকবার চুমুক দিয়ে বললেন, তৈরি থাকিস, আগামীকাল তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো।
এর ঠিক পনেরো দিন পর আদনান সাহেব খুব ব্যাস্ত। তিনি সারাক্ষণ ছুটাছুটি করছেন এদিকওদিক। খুবই প্রফুল্ল চিত্তে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। নিজের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা, কোনো কিছুরই যেন কমতি না হয়।
হঠাৎ আদনান সাহেবের দু’জন প্রতিবেশী মতিন সাহেব এবং রতন সাহেব একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, আপনার ছেলে কি মেয়ে নিয়ে পালিয়েছিল? আদনান সাহেব মুচকি হেসে বললেন, না না এরকম কিছুই না।
রতন সাহেব আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন, কেউ আছে কিনা। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তাহলে কি আপনার ছেলে উল্টাপাল্টা কাজ করেছিল, নাকি এর ফলে মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়েছিল আর আপনি ইজ্জতের ভয়ে বিয়ে করিয়ে দিলেন।
আদনান সাহেব বললেন, ওরকম কিছুই না, ভাই। আমি আমার পছন্দের মেয়ের সাথেই আমার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি। রতন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কোনো কেলেঙ্কারি হয় নি, তাহলে শুধু শুধু এ অল্প বয়সে ছেলেটাকে বিয়ে করিয়ে ছেলেটির জীবনটা কেনো নষ্ট করলেন? এটুকু একটা ছেলে বউকে কি খাওয়াবে? ছেলেটা যদি পড়াশোনা শেষ করে একটা জব করতো তাহলে ভালো একটা পরিবারে বিয়ে করতে পারতো, ভালো একটা পর্যায়ে যেতে পারতো।
আদনান সাহেব তখন বললেন, আপনার চোখে আমার ছেলে ছোট থাকলেও আমার চোখে আমার ছেলে যথেষ্ট বড় হয়েছে আর আমি আমার ছেলের জীবন নষ্ট করিনি। বরং নষ্ট হয়ে যাওয়া জীবন থেকে আমার ছেলেকে রক্ষা করেছি।
আমাদের দেশে একটা নিয়ম হলো, কোনো ছেলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বিয়ে করতে পারবেনা, আগে প্রতিষ্ঠিত তারপর বিয়ে। কিন্তু একটা ছেলে পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে ২৮ থেকে ৩০ বছর। অথচ ১৬ থেকে ১৭ বছরের পর থেকে একটা ছেলে তার জৈবিক চাহিদা অনুভব করতে থাকে। কষ্ট করে আরও দু’এক বছর নিজেকে কন্ট্রোল করলেও পরে আর নিজেকে কোনোভাবেই আটকাতে পারেনা।
আর ঠিক তখনই প্রেম নামক একটা অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হয়। আর তখনতো ছেলেমেয়ে রুম ডেট করে নয়তো ফোন সেক্স করে অথবা সমেহোন করে নিজের জৈবিক চাহিদা মিটায়। আবার কেউ কেউ পতিতালয়েও চলে যায়।
এভাবেই সে বিয়ের আগ পর্যন্ত নিজের জৈবিক চাহিদা মিটাতে থাকে। অথচ ঘরে বউ থাকলে হয়তো এ জঘন্যতম পাপ কাজটাই করতে হতোনা।
আর আমাদের বাবা-মায়েদের একটা ধারনা হলো, ছেলে বেকার থাকলে বউকে কি খাওয়াবে? আরে, বউকি রাক্ষসী নাকি যে, দুনিয়ার সমস্ত খাবার খাওয়াতে হবে! তাহলে সমস্যা কোথায়? আমরা যা খাই ছেলের বউ সেটাই খাবে। আজ আমার ছেলে বেকার কিন্তু কাল সে বেকার থাকবেনা।
যখন সে দেখবে, তার অর্ধাঙ্গিনী আছে তখন সে এমনিতেই দায়িত্ববান আর কর্মঠ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ছেলে যদি কোনো পতিতালয় কিংবা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হোটেলে ধরা খেত, তাহলে সে দাগ কিন্তু কখনোই মুছতো না।
আমাদের সমাজের বাবা-মায়েরা মেয়েদের কখনোই বেকার ছেলেদের সাথে বিয়ে দিতে চায় না। সবাই চায় যে, মেয়েকে একটা প্রতিষ্ঠিত ছেলের হাতে তুলে দিতে। সবাই খোঁজ নেয় যে, ছেলের ভালো কোনো চাকরি কিংবা ব্যবসা আছে কিনা, ছেলে মাসে কত টাকা ইনকাম করে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেউই খোঁজ নেয় না যে, ছেলেটা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছে কিনা, ছেলের চলাফেরা কেমন। এসবের কোনোই খোঁজ নেয়না। আমরা বাবা-মা চাই আগে ছেলেমেয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক তারপর বিয়ে। অথচ আমরা এটা ভেবেই দেখিনা যে, ছেলেমেয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে আমাদের চোখের আড়ালে নিজের জৈবিক চাহিদা মিটানোর জন্য কত কিনা করছে!
আদনান সাহেবের কথা শুনে মতিন সাহেব আর রতন সাহেব দু’জনেই চুপ হয়ে আছে। আদনান সাহেব তখন রতন সাহেবের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভাই একটা কথা মনে রাখবেন ছেলেমেয়ে সাবালক হলে মা-বাবা যদি বিয়ে না করায়, তাহলে ছেলেমেয়ের অবৈধ জৈবিক চাহিদার দায়ভার বাবা-মাকেও কিন্তু ভোগ করতে হবে আর সেটা ইহকাল হোক বা পরকাল হোক।
তো, যাইহোক আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। আর বোরহানিটা কিন্তু খুবই মজা হয়েছে। বাসায় যাওয়ার সময় পরিবারের জন্য একটু নিয়ে যাবেন। আদনান সাহেব মুচকি হেসে এরপর তাদের কাছ থেকে চলে গেলেন।
প্রতিবেশীর এসব ফালতু কথায় কান দিলে চলবেনা। তার একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। কোনো কিছুরই যেন কমতি না হয়। আজ আদনান সাহেব পৃথিবীর সবচাইতে সুখী বাবা।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
লাস্টনিউজবিডি/ এসএমএ
সর্বশেষ সংবাদ
Comments are closed