ট্রাম্প-হিলারিতে মার্কিনিদের ব্যাপক অনাস্থা

লাস্টনিউজবিডি, ৩১ অক্টোবর, ডেস্ক: মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সেখানে পরিচালিত সাম্প্রতিক কয়েকটি জরিপে নাগরিকদের তীব্র হতাশা আর ভয়াবহ ক্ষোভের আভাস মিলেছে। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাবলিক রিলিজিয়ন রিসার্স ইন্সটিটিউট (পিআরআরআই), শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল অপিনিয়ন রিসার্চ সেন্টার-এনওআরসি এবং পিউ রিসার্স-এর পরিচালিত ওই জরিপগুলো বলছে, অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকান এখন আর ডেমোক্র্যাট অথবা রিপাবলিকান কোনও দলের প্রতিই আস্থা রাখতে পারছেন না।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, দুইটি দলের কেউই জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে আমলে নেয়নি। উভয় শিবিরই তাই জনগণের আস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে প্রার্থীদের প্রতি আস্থাহীনতার সব অতীত রেকর্ড ভেঙে ফেলেছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
জরিপের ফলাফল বলছে, অধিকাংশ মার্কিন জনগণ তাদের দুজনকেই ভয়ঙ্কর হিসেবে দেখছে।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান দুই প্রার্থীর প্রতি জনগণের এই অনাস্থাকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে রায় দিয়েছে। প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বার্নি স্যান্ডার্সের মনোনয়ন না পাওয়া নিয়ে জনগণের হতাশার কথাও উঠে এসেছে জরিপের ফলাফলে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা নির্বাচন নিয়ে মার্কিন জনতার এই অবস্থানের বিপরীতে সেখানকার সমাজের বিরাজমান বিভক্তিকে দুষছেন। দুষছেন অর্থনৈতিক বৈষম্যকে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিচু তলার মানুষের অংশগ্রহণ না থাকাকেও অনাস্থার কারণ মনে করছেন তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজে বৈষম্যের বিস্তৃতি, খাদ্যসঙ্কট, কর্মসংস্থানের অভাব, জাতীয় ঋণ বেড়ে যাওয়া, বর্ণবাদের বিস্তৃতি, বীমা করার অক্ষমতা, নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি দুই দলের প্রতি আস্থাহীন করে তুলেছে সে দেশের নাগরিকদের।
আর খোদ প্রার্থীদের প্রতি ঐতিহাসিক অনাস্থার ক্ষেত্রে হিলারির ফাঁস হওয়া ইমেইল তথ্য এবং ট্রাম্পের ভয়াবহ বর্ণবাদী-সহিংস ভাষ্য ও নারীবিরোধী অবস্থানকে কারণ বিবেচনা করা হচ্ছে।
গত সেপ্টেম্বরে নমুনায়নের দৈবচয়ন পদ্ধতি ব্যবহার করে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ২,০১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে এক জরিপ পরিচালনা করে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাবলিক রিলিজিয়ন রিসার্স ইন্সটিটিউট (পিআরআরআই)।
আরেকটি জরিপ পরিচালিত হয় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ওপিনিয়ন রিসার্চ সেন্টার এনওআরসি-এর তহবিলে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স রিসার্স ওই জরিপটি পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ১০৬০ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ওপর জরিপটি পরিচালিত হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু, জনমত ও ডেমোগ্রাফিক তথ্য নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার সেপ্টেম্বরে আরেকটি জরিপ সম্পন্ন করে।
পিআরআরআই-এর জরিপের আভাস অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির প্রতি মার্কিনিদের অসন্তোষ দিন দিন বাড়ছে। এখন ৬১ শতাংশ মার্কিনি নির্বাচন নিয়ে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। প্রতি ১০ জনে ৬ জনেরও বেশি মার্কিনি মনে করেন, প্রধান দুই দলের কোনটিই মার্কিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারে না।
মার্কিন জনগণের কাছে এবারের নির্বাচনে প্রধান দুই দলের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা এতো কম হওয়ার ঘটনাটিও ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জরিপে আভাস মিলেছে, ১৯৯০ সাল থেকে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দুই দলের প্রতিই মার্কিনিদের অসন্তোষ তীব্রভাবে বাড়ছে। সে সময় চালানো জরিপে দেখা গিয়েছিল, দুই দলের কেউই জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে সমর্থ হয় না বলে মনে করতেন মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কম মার্কিনি।
তবে ২০১৬ সালে এসে অর্ধেকেরও বেশি মার্কিনি মনে করেন দুই দলের কেউই এখন আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স রিসার্স-এর জরিপের ফলাফলেও এ বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ৭০ শতাংশ মার্কিনিকে হতাশা বোধ করতে দেখা গেছে। জরিপ বলছে, ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান এ দুই দলের প্রতিও মার্কিনিদের হতাশার মাত্রাটা প্রায় একই রকমের।
জরিপে দেখা যায়, নির্বাচন নিয়ে অর্ধেকেরও বেশি মার্কিনি অসহায় বোধ করছেন। সমান সংখ্যক মানুষের মনে নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। দেশের রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রতি আস্থার অভাব রয়েছে প্রতি ১০ জনে ৯ জন আমেরিকানেরই। আর রাজনৈতিক বিভক্তির বাস্তবতায় নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের প্রতি আস্থাহীনতার ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য নেই। রাজনৈতিক দল, মনোনয়ন প্রক্রিয়া এবং সরকারের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দুই দলের অধিকাংশ সমর্থকই আস্থা রাখতে পারেন না।
সব মিলিয়ে জরিপের আভাস অনুযায়ী রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্র্যাট কেউই নতুন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটাতে পারছেন না বলে মনে করছেন অধিকাংশ আমেরিকান। তারা কোনও সুযোগ্য নেতৃত্বকেও পাচ্ছেন না, যারা তাদের সামনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করবে।
মার্কিন নির্বাচন
জরিপের ফলাফল বলছে, বার্নি স্যান্ডার্সকে নেতা হিসেবে পছন্দই করেছিলেন আমেরিকানরা।
তারা মনে করছেন, রিপাবলিকান পার্টির হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি তার দলের জন্য যতটা না ভালো হয়েছে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থিতা প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্সকে মনোনয়ন দেওয়া হলে সেটি তার (স্যান্ডার্স) দলের জন্য আরও বেশি ভালো হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মেটাল কোম্পানির প্রেসিডেন্ট স্টিফেন গ্লিসন। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্নাতককে সিএনএন, ফক্স নিউজ, সিএনবিসি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ওয়াশিংটন টাইমস এবং ন্যাশনাল রিভিউ-এর মতো সংবাদমাধ্যমগুলো যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে।
তিনি মনে করেন, ২০১৬ সালের নির্বাচন মার্কিন সমাজের কদর্যতাগুলোকে সামনে এনেছে। ভাঙচুর-শারীরিক আঘাত-বড় মাত্রার বর্ণবাদী দাঙ্গা থেকে জঙ্গিবাদী বোমা হামলা এবং বিপণী কেন্দ্রে ছুরিকাঘাত, দুই দলে বিভক্ত আমেরিকায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা জনজীবনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তিনি আরো মনে করেন, গোটা সমস্যায় ট্রাম্পকে দায়ী করার একটা প্রবণতা রয়েছে সেখানকার প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাশক্তির। তবে এর সঙ্গে দ্বিমত করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে ট্রাম্পের সমর্থকরা রাজনৈতিক সহিংসতার ধারক নয় বরং শিকার। উপরন্তু সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করার মতো শক্তিগুলো বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়ে আসছিলো। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ মিলে বিপুল সংখ্যক আমেরিকান একমত যে ওবামার অধীনে আন্তঃবর্ণ সম্পর্ক তিক্ততর হয়েছে। দেশের প্রথম আধা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারবার বর্ণবাদী উস্কানিদাতাদের পক্ষ নিয়েছেন এবং পুলিশবিরোধী দাঙ্গার সমালোচনা করেছেন। তার অ্যাটর্নি জেনারেল লরেটা লিঞ্চ বিদ্বেষপূর্ণ বর্ণবাদী বয়ানের আইনি বৈধতা দিয়েছেন; যার বাস্তব ভিত্তি নেই বললেই চলে।’
স্টিফেন গ্লিসন মনে করেন, ওবামার বর্ণবাদী শাসনপ্রণালীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন বর্ণবাদী ক্ষত নিয়ে দেশত্যাগ, জাতীয় ঋণ প্রায় প্রায় দ্বিগুণ হওয়া (২০ ট্রিলিয়ন), ঐতিহাসিকভাবে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া, খাদ্য সংকটের তীব্রতা এবং খোদ মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বাস্থ্যবীমার মতো জরুরি বিষয়গুলোর সামর্থ্য না থাকার প্রশ্নগুলো ২০১৬ সালে নির্বাচনি পরিস্থিতিকে এমন হতাশাব্যঞ্জক-অস্থির-সহিংস করে তুলেছে। সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, শ্যালন, নিউইয়র্ক পোস্ট, গার্ডিয়ান, গ্লোবাল রিসার্চ।
লাস্টনিউজবিডি/এমএইচ