কি হচ্ছে সাবমেরিন কেবল কোম্পানিতে !

আলীমুজ্জামান হারুন,লাস্টনিউজবিডি,৭ ডিসেম্বর ঢাকা: সাবমেরিন কেবল কোম্পানির (বিএসসিসিএল) ডিজিএম জাহাঙ্গীর আলমের চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া চলছে। তার বিরুদ্ধে কুয়াকাটা দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল স্টেশনের(এসএমই-৫) পিডি থাকাকালীন ৯০ হাজার টাকার ঘাপলা পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যেই তাকে পিডি থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় আনা হয়েছে। তার স্থানে ডিজিএম ( ব্যন্ডউইথ)পারভেজ মনন আশরাফকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও তিনি ঢাকায় বসেন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পিডি থাকাকালীন সময়ে ব্যয় নিয়ে সাবমেরিন কেবলের এমডি প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন ম্যানেজার পর্যায়ের কর্মকর্তা সাহাদাত হোসেনকে দিয়ে এক সদস্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জাহাঙ্গীর অালমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। এই ফাইলটি এখন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে রয়েছে। সচিব মো: ফয়জুর রহমান এবং সাবমেরিন কেবলের এমডি মনোয়ার হোসেন এক সঙ্গে বিদেশ সফরে অাছেন। বিদেশ থেকে সচিব ফেরত অাসলেই এই ফাইল নাড়াচারা শরু হবে। সচিব ও এমডি বিদেশ থাকায় এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
সচিব পদাধিকার বলে সাবমেরিন কেবল কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদেরও চেয়ারম্যান।
সুত্র জানায়, সরকারি এই কোম্পানির এমডি ২০০৮ সাল থেকে একই কোম্পানির এমডি হিসাবে কর্মরত অাছেন। যখন যে সচিব অাসেন তখন তার সাথে এমডি গভীর সখ্যতা গড়ে তোলেন। সে কারনে সাব-মেরিন কেবল কোম্পানির অন্যান্য কর্মকর্তারা সবসময় ভয়-ভীতির মধ্যে কাজ করেন। কারন হিসাবে নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলেন, এমডি অত্যান্ত সুকৌশলে সাবেক সচিব সুনীল কান্তি বোসকে দিয়ে মন্ত্রনালয় থেকে যাবতীয় ক্ষমতা বোর্ডের কাছে নিয়েছেন। পদাধিকার বলে বোর্ডের সচিব খোদ এমডি। তিনি যা বোর্ডে উপস্থাপন করবেন বোর্ড সদস্যরা তাই জানবেন। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক বোর্ডের একজন পরিচালক বলেন, কোন কোন বোর্ড সভায় ৩০ -৪০টি এজেন্ডা দেয়া হয়। গুরুত্বপূর্ন এজন্ডাগুলো থাকে শেষে। অনেকক্ষন সভা চলার পর চেয়ারম্যান সভা শেষ করে দেন। সভার সিদ্দান্তসমুহ লিখে এমডি চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর করিয়ে নেন। যে সব বিষয়ে উপস্থাপনই হয়নি তাও অনুমোদন করিয়ে নেন বলে তাঁর অভিযোগ।
সুত্র অারো জানায়, সাবমেরিন কেবলের সার্ভিস রুল থেকে শুরু করে সবকিছুই এই এমডির সুবিধামত করা। উর্ধতন অফিসার ছাড়া সকল ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারি এমডি নিয়োগ দেন। প্রয়োজনে তিনি চাকরি খেতেও পারেন। সিএসআর ফান্ড থেকে শুরু করে তার কাছে রয়েছে নানা খাত। যে কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তির অনুরোধ তিনি রক্ষা করেন। এ কারনে তার হাত অনেক লম্বা। কাউকে কেয়ার করে তিনি চলেন না । তার বিরুদ্ধে অনেক জাতীয় দৈনিকে নানা ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তিনি আরো দাপটে চলছেন। তার একগুয়েমির কারনে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর লোকসানের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলছে। কমে গেছে অর্ধেক আয়।
সাব-মেরিন কেবলের একটি সূত্র জানায় , জাহাঙ্গীর আলম একজন ডিজিএম। তার অনিয়মের তদন্ত করার জন্য ম্যানেজার পর্যায়ের কর্মকর্তাদে দায়িত্ব দেয়ায় বিষয়টি অন্যান্য কর্মকর্তারা ভালো চোখে দেখে নাই। এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির কাছে জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য হচ্ছে, তাকে পিডি বনানো হয়েছে নামকা ওয়াস্তে। ঠিকাদারের যাবতীয় বিল থেকে শুরু করে সব কিছুই করতেন এমডি নিজে।তিনি স্ব-পরিবারে কুয়াকাটা থাকতেন। মাত্র ৪৪ লাখ টাকা তার হাতে খরচ হয়েছে কর্মচারীদের বেতন -ভাতা খাতে। ঠিকাদারের বাউন্ডরি ওয়ালের বিল ২ কোটি টাকা সহ সব বিলই ঢাকা অফিস থেকে এমডি পরিশোধ করেছেন। অবশ্য গত মাসে বাইন্ডরিওয়ালের ৩শফুট ধসে গেছে।
এ বিষয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন এবং দ্রুত প্রতিবেদন চেয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে। তদন্ত কমিটি দুই দফায় এমডির শুনানি গ্রহন করেছেন। এই তদন্ত কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সৎ কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত যুগ্ম প্রধান ওসমান গনি তালুকদারকে।
উল্লেখ্য, সাড়ে ৬ শ কোটি টাকা ব্যয়ে কলাপাড়ার আমখোলাপাড়ায় নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন। এর কারিগারি ঠিকাদার জাপানের এনইসি কোম্পানি। ২০১৪ সালে এই কোম্পানির সাথে সাবমেরিন কেবল কোম্পানির চুক্তি হয়। কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে । শেষ হবে ২৭ মাসে । ২৭ জুন ১৬ সালে ।
স্থানীয় পর্যায় ভৌত অবকাঠামোর কাজ চলছে । নির্মীত হচ্ছে বাইন্ডরি ওয়াল। নির্মান কাজ শেষ না হবার আগেই প্রায় তিন শ’ ফুট সীমানা প্রাচীর ধ্বসে পড়েছে। ৮ অক্টোবর সকালে সীমানা দেয়ালের পশ্চিম পাশের অংশ ধসে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। হস্তান্তরের আগেই বাউন্ডারি দেয়াল ধসের ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কাজের গুণগত মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে । ঠিকাদার বিলও পেয়েছে।
জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কে. কে. এন্টারপ্রাইজ প্রথম পর্যায়ে ১০ একর জমিতে বালু ভরাট ও ১৭২০ ফুট দীর্ঘ এবং ১১২০ ফুট প্রস্থ সীমানা প্রাচীরের কাজ সম্পন্ন করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল ভবন, প্রধান ফটক ও শোভাবর্ধনের কাজ করে আসছে। যা এ বছরের নবেম্বরে সাবমেরিন কোম্পানির কাছে হস্তান্তরের কথা । এরই মধ্যে পশ্চিম পাশের অন্তত তিন শ’ ফুট সীমানা প্রাচীর ধসে পড়ে।
কাজের গুণগত মান বজায় রাখতে ইতোপূর্বে নিয়োজিত কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান সিভিল ওয়াস ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার লিখিত ও মৌখিক নির্দেশনা দেয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের মূল ভবনসহ অন্যান্য কাজে নিম্মামনের ইট, বালু, পাথর, সিমেন্ট, রড ব্যবহার করেছে বলে একাধিক নির্মাণ শ্রমিকের দাবি। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কে. কে. এন্টারপ্রাইজ কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি প্রকল্প এলাকায় বালু ভরাটের সময় পাশের ফসলি জমিতে লবণ পানি যাতে প্রবেশ না করে এ জন্য পানি নিষ্কাশন বন্ধ রাখা হয়েছিল। বর্ষা মৌসুমে জমে থাকা পানির প্রবল চাপে দেয়াল ধসের ঘটনা ঘটেছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইমরান জানান, প্রকল্প এলাকায় চারদিকে প্রস্তাবিত ১০ ফুট সড়ক নির্মাণসহ ড্রেনেজ ব্যবস্থা চালু হলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে।
প্রকল্প সংলগ্ন বাসিন্দা আঃ লতিফ মোল্লা আক্ষেপ করে জানান, এত বড় প্রতিষ্ঠানের কাজে অনিয়ম না হলে ভেঙ্গে পড়ল কেন। তার ভাষ্য, ‘খারাপ ইটসহ বাজে মাল দিয়া কাম করছে মনে হয়।’
প্রকল্পের কাজের গুণগতমান নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কে. কে এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোঃ কবির হোসেন বলেন, ‘পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় পানির প্রবল চাপে সীমানা প্রাচীর উপড়ে পড়েছে।’
সাবমেরিন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মনোয়ার হোসেন ঘটনার পর জানান, সামান্য বৃষ্টিতে কেন সীমানা প্রাচীর ধসে পড়ল তা
খতিয়ে দেখা হবে এবং দ্রুত গতিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেয়াল রিপিয়ারিং করা হবে।
সীমানা প্রাচীর ধসের ঘটনাটি বরিশাল অঞ্চলে সবার মুখে মুখে । সকলের কথা সাবমেরিন কেবলের উদাসিনতায় এটা হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের সরাসরি নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি এখনও রিপোর্ট
জমা দেয়নি বলে জানা গেছে।